মনের জটিল রোগ, সিজোফ্রেনিয়া!১৯১১ সালে সুইডেনের মনোচিকিৎসক ব্লিউলার
সিজোফ্রেনিয়া শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সিজোফ্রেনিয়া একটি তীব্র মাত্রার
জটিল মানসিক রোগ। সিজোফ্রেনিয়া শব্দটি এসেছে মূলতঃ গ্রীক ভাষা থেকে। এর
প্রথম অংশটিকে বলা হয় ‘সাইজো’ বা ‘সিজো’, যার অর্থ ভাঙ্গা বা টুকরো!
দ্বিতীয় অংশটি হল ‘ফ্রেনিয়া’ বা মন! অর্থাৎ, পুরোটা দাঁড় করালে হয় ভাঙ্গা
মন বা টুকরো টুকরো মন!অনেকেরই এ রোগটি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। মানব
মস্তিষ্কে নিওরন বা স্নায়ুকোষের পরিমাণ অসংখ্য। এটিসংখ্যায় বিলিয়ন বিলিয়ন
হতে পারে। প্রত্যেক নিওরনের শাখা প্রশাখা থাকে, যার সাহায্যে সে অন্য
স্নায়ু বা মাংশপেশী বা অন্য কোন গ্রন্থি থেকে উদ্দীপনা গ্রহণ করতে পারে। এই
নিওরন বা স্নায়ুকোষের শেষাংশ বা টার্মিনাল থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ
নিঃসরিত হয়। এগুলোকে বলে নিওরোট্রান্সমিটার। এগুলির সাহায্যেই নানা ধরণের
উদ্দীপনা স্নায়ুকোষ থেকে স্নায়ুকোষে পরিবাহিত হয়। এভাবে আমরা উদ্দীপনা লাভ
করে থাকি। সিজোফ্রেনিয়া রোগটিতে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা মস্তিষ্কের
স্বাভাবিক কার্যকলাপ বিঘ্নিত হয়! সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির অনুভূতি,
চেতনা, কাজকর্ম বাস্তবের সাথে সঙ্গতিহীন বা খাপছাড়া হয়। এরা নিজের মত করে
সবকিছু ভাবে, নিজের একটা ভূবন তৈরী করে নেয় যেটি বাস্তবের চিন্তাচেতনার
বাইরে। এ রোগটিতে মস্তিষ্কের রসায়ন পরিবর্তিত হয়ে যায়। এদের বোধশক্তি কাজ
করে না বা কমে যায়, যা তাদের আচরণকে ভূল পথে পরিচালিত করে। মাঝে মাঝে এদের
কার্যকলাপ ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। রোগটি এত ধীরগতিতে অগ্রসর হয় যে, অনেক সময়
তাদের পরিবার বুঝতেই পারেন না। এটি বোঝা যায়, শুরু বা প্রকাশ হয় সাধারণতঃ
১৮ বছর বয়স থেকে। তাদেরকে তাদের আচরণের জন্য পরিবারের সদস্যরা ভয় পান বা
অস্বস্তিতে ভোগেন।উপসর্গ:আক্রান্ত রোগীদের ভেতর সাধারণতঃ হ্যালুসিনেশন,
অলীকপ্রত্যক্ষণ, সন্দেহ প্রবণতা, গায়েবী আওয়াজ শোনা, ডিলিওশান বা ভ্রান্ত
বিশ্বাস, আচরণের নাটকীয় পরিবর্তন, অনীহায় ভোগা, অস্থিরতা, অবসাদগ্রস্থতা,
বিষন্নতা, স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাতে ব্যর্থ হওয়ার উপসর্গগুলো দেখা যায়।
রোগী সব সময় ভাবে, সবাই তার শত্রু, সবাই তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে! এদের মনে
নিজস্ব কিছু দৃষ্টিভঙ্গী পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসে, যেমন ধর্মীয়, পারিবারিক,
সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংষ্কৃতিক। অনেক সময় রোগী গোসল করা বা নখ কাটা
অর্থাৎ নিজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। অসামাজিকতা বা
সমাজ থেকে বিচ্যুত হন, নিজের মত করে একা একা থাকা চলতে থাকে। এদের
অস্বাভাবিক বিশ্বাস থাকে যে, এদের নিয়ে সবাই সমালোচনায় লিপ্ত, যদিও অন্যরা
নিজেদের মধ্যে অন্য বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের পেছনে পুলিশ,
গোয়েন্দা কেউ লাগিয়ে দিয়েছে, এদের মনে ভ্রান্ত ধারণাএত বেশী থাকে যে এদেরকে
প্যারানয়েড বা সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ বলা হয়! এরা ভাবে, এদের মনের কথা,
চিন্তা চেতনা অন্যরা কি ভাবে যেন জেনে ফেলছে! এরা ভাবে, কেউ তার ভাল দেখতে
পারে না! মাঝে মাঝে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় রোগীর এক ধরণের দুঃখবোধ তৈরি হতে
পারে।ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি সিজোফ্রেনিয়া অনেক ক্ষেত্রে তীব্র মাত্রায়
দেখা যায়। এদের আবেগ ভোঁতা হয়ে যায়। এ রোগটির সাথে আত্মহত্যার গুরুত্বপূর্ণ
সম্পর্ক রয়েছে। ডিলিওশান বা ভ্রান্ত বিশ্বাসের জন্যই এদের ভেতর সুইসাইডাল
টেন্ডেন্সি বা আত্মহত্যা প্রবণতা তৈরী হয়! অনেক সময় এই প্রবণতাটির
লক্ষণগুলো রোগীর কাছের মানুষেরা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেনঃ১। রোগী
যদি সব সময় সুইসাইডের কথা বলে,২। যদি কখনো সুইসাইডের প্ল্যানের কথা
জানায়,৩। রোগীর যদি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাহত অনুভূতি থাকে,৪। নিজের সম্পর্কে
যদি সব সময় হীনমন্যতা থাকে,৫। যদি কোন অলীক প্রত্যক্ষণ দেখতে পায়, যা তাকে
আত্মহত্যা করতে উৎসাহিত করে।কারণ:এ রোগটি প্রধাণতঃ বংশগত বা জেনেটিক্যাল।
বংশের কারো না কারো এটি থাকলে কোন না কোন জেনারেশনে প্রকট অথবা
প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশিত হতে পারে কারো কারো ক্ষেত্রে! সতর্কতা:এদের সাথে
নরমভাবে কথা বলুন। এদেরকে কখনই উত্তেজিত করা যাবে না, কেননা তা অনেক সময়
ভয়ংকর বিপদ বয়ে আনতে পারে। সব সময় এদের সাথে ইতিবাচকভাবে কথা বলুন, অহেতুক
মানসিক চাপ বা দায়িত্ব এরা নিতে পারে না, এটি বোঝার চেষ্টা করুন। এদের
প্রতি সহনশীল আচরণ করুন, যত্নশীল হোন। সবসময় মনে রাখবেন, যে কারো ক্ষেত্রে,
যখন তখন শরীরের মত মনও অসুস্থ হতে পারে!চিকিৎসা:কোন সংকোচ বা দ্বিধা ছাড়াই
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনোচিকিৎসক বা সাইকিয়াট্রিস্ট এবং কাউন্সেলর বা
সাইকোথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হোন। এ রোগটিকে মেডিসিনও কাউন্সেলিংএর মাধ্যমে
নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রোগী এতে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেন এবং স্বাভাবিক
জীবনযাপন করতে পারেন। রোগটি নিয়ন্ত্রণের পর রোগী যেন সামাজিক জীবনে চলমান
থাকতে পারেন, কারিগরী বা বৃত্তিমূলক জীবিকা অবলম্বন করতে পারেন সে দিকে
কাউন্সেলর উৎসাহিত করবেন। অন্তর্দৃষ্টিমূলক সাইকোথেরাপি এক্ষেত্রে
মেডিসিনের সাথে ভাল কাজ করে। এই বিশেষ থেরাপি রোগীকে তার নিজস্ব জগত থেকে
বাস্তব জগতে ফিরিয়ে এনে সেখানে কিভাবে খাপ খাইয়ে চলবেন সেটিতে সাহায্য করতে
পারে। এছাড়া সমর্থনমূলক থেরাপি এক্ষেত্রে রোগীর সামাজিকীকরণ ও অর্থনৈতিক
পুনর্বাসনে কাজে লাগে। তাই আর লজ্জা নয়, লুকোচুরি বা দ্বিধা নয়।
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদেরও রয়েছে সমাজে, পরিবারে সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার!
এ রোগটি সম্পর্কে জানুন ও সচেতন হোন! আপনার এই সচেতনতাই বাঁচিয়ে দেবে একটি
প্রাণ, একটি পরিবার ও আপনাকে!
-Copy from Afsana Pervin Sonia
-Copy from Afsana Pervin Sonia
No comments:
Post a Comment