Wednesday, February 24, 2016

পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় পদ্ধতি

(স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের জন্যে প্রযোজ্য)
যা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ 
রোগের উপসর্গ- যা রোগী বুঝতে পারে।
রোগের লক্ষণ- রোগীকে পরীক্ষা করার সময় আপনি যা লক্ষ্য করবেন। রোগের উপসর্গ বা লক্ষণগুলো জানার জন্য প্রয়োজন রোগীকে প্রশ্ন করা এবং তার উত্তরগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা। শিশুদের বেলায়, বা যে রোগীরা কথা বলতে পারে না তাদের বেলায় লক্ষণগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

রোগীকে সবসময় প্রচুর আলোয় (দিনের আলো হলে ভালো) পরীক্ষা করতে হবে, অন্ধকার ঘরে কখনই নয়।

রোগীকে পরীক্ষা করার সময় রোগী থেকে পাওয়া তথ্যগুলো লিখে রাখতে হবে, যাতে প্রয়োজন হলে স্বাস্থ্যকর্মীকে দেখাতে পারেন।

রোগীকে কেমন করে পরীক্ষা করবেন-
রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রথমই প্রয়োজন রোগী বা রোগিনীর রোগ বৃত্তান্ত এবং দৈহিক নিরীক্ষার। রোগীর অসুবিধার উপর এবং সম্ভাব্য সমস্যা বুঝে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। অতঃপর ফলাফলের উপর নির্ভর করে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র এবং ওষুধ নির্বাচন করতে হবে।

শুরুতে রোগী তার নিজের অসুবিধার কথা বলবে। আপনি মনোযোগ দিয়ে তা শুনবেন। পরবর্তীতে আপনি রোগীর কাছে জানতে চাইবেন-
  • সব চাইতে বেশি অসুবিধা কী?
  • কিসে আরাম হয়, আর কিসে বাড়ে?
  • কখন, কিভাবে শুরু হয়েছিল?
  • অতীতে এই ধরনের অথবা অন্য কোন জটিল রোগের অভিজ্ঞতা আছে কি না?
  • পরিবারের অথবা পাড়ায় কখনো এ ধরনের অসুখ কারো হয়েছে কি না?
রোগী কোনো ব্যথার কথা জানালে, তাকে জিজ্ঞাসা করবেন-
  • কোথায় ব্যথা হচ্ছে? (রোগীকে একটা আঙ্গুল দিয়ে ঠিক জায়গাটা দেখাতে বলবেন)
  • ব্যথাটি কি সব সময় থাকে, না আসে যায়?
  • ব্যথাটা ঠিক কী রকম? (জোরালো? কম? জ্বালার মত?)
  • ব্যথার জন্য ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে কি না?
রোগী যদি শিশু হয়, যে এখনও কথা বলতে শিখেনি, তার জন্য লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কী ভাবে সে কাঁদছে, তার নড়াচড়া কেমন ইত্যাদি (যেমন যদি শিশুর ডানকানে ব্যথা হয়, তবে সে মাথার ডান দিকটা রগড়াবে বা ডানপাশের কানটা টানাটানি করবে)। তাছাড়া শিশুটির মায়ের কাছ থেকেও ভালভাবে সবকিছু জেনে নিতে হবে।

রোগী সম্পর্কে জ্ঞাতব্য বিষয়

স্বাস্থ্যের সাধারণ অবস্থা

১. রোগীর পরিচয় ঃ প্রথমে রোগীর নাম, বয়স, পেশা, ধর্ম, ওজন (যদি অনেকদিন ধরে কারো ওজন ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে তবে সে হয়তো কোন পুরানো (ক্রনিক) রোগে ভুগছে, ইত্যাদি জানতে হবে।

২. রোগীর অসুবিধা ঃ অতীত এবং বর্তমানের প্রধান অসুবিধা। অর্থাৎ কী অসুবিধার কারণে রোগী ডাক্তরের নিকট চিকিৎসা গ্রহণের জন্য এসেছে।

৩. দৈহিক পর্যবেক্ষণ ঃ ইহা সাধারণত ঃ ২টি ভাগে ভাগ করা হয়।

ক) সাধারণ পর্যবেক্ষণ এবং খ) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ।

ক) সাধারণ পর্যবেক্ষণ-
রোগীর গায়ে হাত দেবার আগে তার অনুমতি নিয়ে তাকে পরীক্ষা করা শুরু করতে হবে। চেহারা (কতটা রুগ্ন বা দুর্বল দেখাচ্ছে), বুদ্ধিমত্তা, ভাবভঙ্গি (কিভাবে সে নড়াচড়া করছে, কেমন করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, তার মাথা ঠিক কাজ করছে কি না), কেশের বিন্যাস, পুষ্টি প্রভৃতির উপর নজর রাখতে হবে।

শরীরের তাপমাত্রা
রোগীর জ্বর না থাকলেও সাধারণভাবে জ্বর পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। তাপ মাপবার যন্ত্র (থার্মোমিটার) না থাকলে আপনার এক হাতের উল্টো পিঠ রোগীর কপালে রাখবেন। রোগীর জ্বর হয়ে থাকলে, তাপের তারতম্য এভাবে নির্ণয় করা সম্ভব।

জ্বর কখন, কিভাবে আসছে, কতক্ষণ থাকছে, কেমন করে ছাড়ছে�এগুলো জানা দরকার। এর থেকে রোগ নির্ণয় করা যেতে পারে। যেমন-
  • প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে।
  • ম্যালেরিয়াতে সাধারণতঃ কাঁপুনি দিয়ে বেশি জ্বর আসে, কয়েক ঘন্টা পরে ছেড়ে যায়, আবার দুই-তিন দিন অন্তর আসে।
  • টাইফয়েড জ্বর রোজ একটু করে বাড়ে।
  • যক্ষ্মাতে সাধারণত ঃ বিকালের দিকে অল্প করে জ্বর আসে। রাতে রোগীর ঘাম হয়ে জ্বর ছেড়ে যায়।

মনে রাখবেন ঃ ছোট বাচ্চাদের শরীরের তাপ যদি অস্বাভাবিক রকম বেশি বা কম (৩৬০ সেঃ-এর নিচে হয়), তবে বুঝবেন যে, কোন মারাত্মক জীবাণু তার শরীরকে আক্রমণ করেছে।

তাপমাত্রা মাপার স্থান ঃ মুখ, বগল ও মলদ্বার।

থার্মোমিটার বা তাপমাপনযন্ত্র : এর সাহায্যে মানবদেহের তাপমাত্রা মাপা হয়। এতে সাধারণতঃ ৯৫ থেকে ১১০ পর্যন্ত দাগ কাটা থাকে। সবচেয়ে কম নম্বরের নিচে থাকে পারদ অংশটি। শরীরের তাপে পারদ উপরের দিকে উঠে। থার্মোমিটার ঝাঁকিয়ে পারদ অংশ নামিয়ে ৯৫/৯৬ ডিগ্রিতে আনা হয়। সুস্থ মানুষের দেহের তাপমাত্রা বগলের নিচে ৯৭.৪ ডিগ্রি এবং জিহ্বার নিচে ৯৮.৪ ডিগ্রি হয়। এর উপরে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে জ্বর বলে ধরা হয়। তবে শরীরের তাপমাত্রা যদি ১০৫/১০৬ ডিগ্রির উপরে হয় তবে তা বিপদজনক।

থার্মোমিটার কেমন করে ব্যবহার করতে হয়- প্রত্যেক বাড়িতে একটি করে থার্মোমিটার রাখা উচিত। রোগীর তাপমাত্রা দিনে ৪ বার নিয়ে লিখে রাখা উচিত।

শরীরের তাপমাত্রা মাপার নিয়ম ঃ

১. প্রথমে থার্মোমিটারটি সাবান পানি দিয়ে ভালভাবে মুছে নিন

অথবা

পানি মিশ্রিত সেভলনে ডুবিয়ে রাখা থার্মোমিটারটি ব্যবহার করুন।

যতক্ষণ না তাপের মাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেঃ ৯৫/৯৬ ডিগ্রি ফাঃ-র নিচে দেখাচ্ছে, থার্মোমিটার জোরে ঝাঁকান।

২. থার্মোমিটার শরীরে লাগান-

জিভের নিচে রেখে মুখ বন্ধ করে বা যদি থার্মোমিটার কামড়ে ফেলার ভয় থাকে তবে বগলের নিচে।

ছোট শিশুর বেলায় ভিজিয়ে বা তেল লাগিয়ে সাবধানে মলদ্বারে।

*যদি রোগী অজ্ঞান অবস্থায় থাকে, তার বগলে বা মলদ্বারে দেবেন।

৩. নির্দিষ্ট স্থানে থার্মোমিটারটি দুই মিনিট রেখে দিন।

৪. থার্মোমিটার শরীর থেকে বের করে নিয়ে তাপমাত্রা দেখে নিন। (বগলের তাপ মুখের চেয়ে একটু কম আর মলদ্বারের তাপ মুখের চেয়ে একটু বেশি দেখাবে।)

৫. এবার থার্মোমিটারটি সাবাান ও পানি দিয়ে ভাল করে ধুয়ে রেখে দিন।

নাড়ী-


হৃদ্পিণ্ডের সংকোচন সম্প্রসারণের জন্য ধমনীতে যে স্পন্দন অনুভূত হয় তাকে নাড়ী বলে।

সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় এর গতি ৭২-১০০ বার প্রতি মিনিটে হয়। তবে বয়সের তারতম্যে এর কিছুটা পরিবর্তন হয়ে থাকে। প্রতি মিনিটে নাড়ী যদি ৬০ বারের কম হয় তাহলে ক্ষীণনাড়ী (ইৎধফুপধৎফরধ) এবং প্রতি মিনিটে নাড়ী ১০০ বারের বেশি হলে দ্রুত নাড়ী (ঞধপযুপধৎফরধ) বলে।

১-৫ বছরের শিশুর ১০০/১২০ বার প্রতি মিনিটে

৬-১৫ বয়সে ৭০/৯০ � �

১৬-৫০ বয়সে ৬০/৮০ �

দেহের তাপমাত্রার সাথে নাড়ীর সম্পর্ক গভীর। স্বাভাবিক অবস্থায় দেহের প্রতি ১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপ বৃদ্ধির জন্য বয়স্কদের নাড়ীর গতি ৮ বার এবং শিশুদের ১০-১২ বার বেশি স্পন্দিত হয়।নাড়ী কেমন করে দেখতে হয়

রোগীর নাড়ী দেখতে আপনার নিজের আঙ্গুল তার কব্জির ওপর রাখুন।

যদি কব্জিতে নাড়ী না পান, রোগীর গলায় শব্দ যন্ত্রের পাশে আঙ্গুল রাখুন।

কিংবা রোগীর বুকের ওপর কান রেখে হার্টের স্পন্দন শুনুন। নাড়ীর স্পন্দনের (ধুক ধুক করা) জোর ও গতি কেমন এবং নিয়মিত কিনা মনোযোগ দিয়ে অনুভব করুন।

বিশ্রামে থাকার সময় নাড়ীর স্বাভাবিক গতি ঃ

বড়দের বেলায়- মিনিটে ৬০ থেকে ৮০ বার

ছোটদের  -  ৮০  ১০০ 

শিশুদের  -  ১০০  ১৪০ 

ঘড়ি না থাকলে নিজের নাড়ীর সঙ্গে মিলিয়ে নিলে রোগীর নাড়ীর গতি স্বাভাবিক কি না অনেকটা বুঝতে পারবেন। নিজে কয়েক মিনিট বিশ্রাম করে তবেই এই কাজটা করবেন। নয়তো পরিশ্রমের ফলে আপনার নাড়ীর গতিবেগ বেশি থাকবে।

নাড়ীর গতি অনেক তাড়াতাড়ি হয়�

পরিশ্রম করলে

ঘাবড়ে গেলে

ভয় পেলে

জ্বর হলে

তীব্র যন্ত্রণা হলে।

প্রতি ডিগ্রি (০ঈ) জ্বরে জন্য নাড়ীর গড়ি ২০ বার করে বাড়ে বলে ধরে নেওয়া যায়। বেশি অসুস্থ রোগীর নাড়ী বার বার দেখে রেকর্ড রাখবেন।

নাড়ীর স্পন্দনের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কি না দেখাটা জরুরি।

যেমন ঃ

�শক� অবস্থায় নাড়ী দুর্বলভাবে দ্রুত চলে।

নাড়ী খুব তাড়াতাড়ি, খুব ধীরে বা অনিয়মিতভাবে চলা হার্টের অসুখের লক্ষণ হতে পারে।

জ্বর বেশি অথচ নাড়ী তেমন তাড়াতাড়ি চলছে না, এটা টাইফয়েডের লক্ষণ হতে পারে।
শোথ (Oedema) : কোথাও শোথ আছে কিনা। সাধারণত পায়ের টিবিয়া হাড়ের উপরে (skin of tibia) এবং গোড়ালির হাড়ের উপরে (Medial Maleolues) দেখা হয়। আঙ্গুল চাপ দিলে শোথ থাকলে বসে যাবে। আবার প্রতিনিয়ত শয়নের রোগীর মেরুদণ্ডের নিচের দিকে সেকরাল প্রমিনেন্সের (Sacral Prominence) উপরে চাপ দেয়া হয়।

পা : পা দু'টিতে কোনো ফোলা আছে কি? এটা সাধারণত চোখে দেখেই বোঝা যায়। ফোলা খুব অল্প হলে গোড়ালির হাড়ের উপরের চামড়া টিপে দেখুন। ফোলা থাকলে সেখানে একটা টোল পড়ে যাবে। যে শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে তাদের পা আর মুখ প্রায়ই ফুলে থাকে। গর্ভবতী মায়ের বেলায় পা ফুলছে কি না দেখাটা বিশেষ জরুরি। প্রস্রাবের কোন সমস্যা থাকলে বা হার্টের কোন গোলমাল থাকলে পা ফুলে যায়। গোদ হলেও পা আর কুঁচকির জায়গা ফুলে উঠে। গোদ কি না বুঝতে হলে আগের মত রোগীর গোড়ালির হাড়ের ওপরের চামড়া টিপে দেখতে হবে। গোদের বেলায় কিন্তু আপনার আঙুলটা সরিয়ে নিলে সেখানে টোল পড়ে থাকবে না।

বাঁকা নখ (Clubbing) : সাধারণত নখের বক্রতা আছে কিনা। নখের উপরের পৃষ্ঠ উঁচু অথবা নখ ভঙ্গুর কিনা তা নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

শ্বাস- প্রশ্বাস (Respiration) : রোগীকে চিৎ করে শুয়েই পেটের উপর একটি কাঠি বা এমন কিছু রাখতে হবে যা শ্বাস-প্রশ্বাসে উঠানামা করতে পারে।

সুস্থ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস : একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক মানুষ ১২-২০ বার/মিনিট শ্বাস নেয়। সদ্যজাত (নবজাতক) শিশু ৪০ বার /মিনিট। ১ বছরের শিশু ৩০-৩৫ বার /মিনিট। ২-৫ বছরের শিশু ২০-২৮ বার/মিনিট। বিশ্রাম বা ঘুমান্ত অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি কম হয় এবং অসুস্থতা বা শারীরিক পরিশ্রমে এর মাত্রা বেড়ে যায়। সাধারণত নিয়ম হচ্ছে প্রতি চারবার নাড়ীর স্পন্দনে একবার শ্বাস গ্রহণ হয়ে থাকে। অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ও নাড়ীর গতি ১: ৪। তবে বক্ষপিঞ্জরের রোগে (chest disease) কখনও নাড়ীর গতি প্রতি মিনিটে ১০০ বার এবং শ্বাসের গতি প্রতি মিনিটে ৫০ বার ধরা হয়। অর্থাৎ শ্বাস ও নাড়ী ২ : ১।

যেমন- নিউমোনিয়া বা শ্বাসকষ্ট, তীব্র হাঁপানি।

রোগী কিভাবে শ্বাস নিচ্ছে সেদিকে বিশেষ নজর রাখবেন।

লক্ষ্যণীয় বিষয়সমূহ :

গভীরতা-ভেতর থেকে শ্বাস নিচ্ছে না ওপর ওপর।

গতি-কত ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে।

কষ্ট-শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে কিনা।

শ্বাস নেবার সময় বুকের দুদিকে সমান ভাবে উঠানামা করছে কিনা। রোগী মিনিটে কতবার শ্বাস নিচ্ছে তা ঘড়ি দেখে গুণে নিন। বেশি জ্বর হলে বা শ্বাস তন্ত্রের কঠিন রোগ (যেমন নিউমোনিয়া) হলে রোগী স্বাভাবিকের থেকে বেশি ঘনঘন শ্বাস নেয়। মিনিটে ৪০ বারের বেশি হালকা শ্বাস সাধারণত নিউমোনিয়া বোঝায়।

ঘড়ি না থাকলে নিজের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোগীর শ্বাস গুণতে পারেন। যদি রোগী একবার শ্বাস নেবার সময়ে আপনার নাড়ীর ৪ বার স্পন্দন হয় তবে তা স্বাভাবিক শ্বাস বলে বুঝবেন। যদি রোগী একবার শ্বাস নেয়ার সময় আপনার নাড়ীর মাত্রা ২ বা ৩ বার স্পন্দন হয় তবে রোগী স্বাভাবিকের চেয়ে তাড়াতাড়ি শ্বাস নিচ্ছে বুঝবেন।

খ) অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ

সঠিকভাবে রোগ নিরূপণ না করে কখনও চিকিৎসায় অগ্রসর হওয়া উচিত নয়। কাজেই চিকিৎসকের জন্য জানা উচিত রোগীর দেহের কী কী জিনিস পরীক্ষা করতে হয়।

সাধারণতঃ রোগী পরীক্ষা করার সময় রোগীর দেহের তাপ, নাড়ী, শ্বাস-প্রশ্বাস, চামড়া, চোখ, কান, মুখ, জিহ্বা ও গলা, পেট ( যকৃৎ, বৃক্ক ও প্লীহা ), পেশী ও স্নায়ু ইত্যাদি দেখতে হয়। প্রস্রাব পায়খানায় রোগীর কোন কষ্ট আছে কি না, কিংবা রোগীর দেহে কী কষ্ট হচ্ছে ও কী কী লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, তা ভালভাবে জানা ও দেখা উচিত। প্রয়োজনবোধে চিকিৎসক ল্যাবরেটরীতে রোগীর রক্ত, মল, মূত্র, কফ ইত্যাদি পরীক্ষা করাবেন।

বুক ও পিঠ (ঈযবংঃ) পরীক্ষা করুন

স্টেথোস্কোপ নামক যন্ত্র দিয়ে বুক ও পিঠ পরীক্ষা করা হয়। এ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করলে সুস্থ শরীরের হার্টের দুটি শব্দ শোনা যায়- লাব্ ডাব্ লাব্ ডাব। হার্টের অসুখে এই শব্দ বিঘি�ত, বিলম্বিত বা অন্য রকম শোনায়। নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিস হলে শোঁ শোঁ বা হিস্ হিস্ শব্দ শোনা যায়। বুকে কাশি বেশি জমলে ঘড় ঘড় শব্দ শোনা যায়। তাই এসব রোগের চিকিৎসা অতি শীঘ্রই করা উচিত। প্লুরিসি রোগে বুকে পানি জমলে ফুসফুসের কোন প্রকার শব্দ পাওয়া যায় না, তবে ড্রাই প্লুরিসি রোগে ঘস্ ঘস্ শব্দ শোনা যায়। হাঁপানি রোগে গলা ও বুকের মধ্যে শিসের মত বা শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায়।

ঘড়ঘড়, শোঁ শোঁ শন্ শন্ প্রভৃতি শব্দ বিভিন্ন রোগ নির্দেশ করে। স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক দেখায় অভ্যন্ত হলে সব শব্দ ঠিকমত বুঝতে পারা যায়।

 কোন রোগী অজ্ঞান অবস্থায় যদি ঘড় ঘড় শব্দ করে বা নাক ডাকার মতো আওয়াজ করে শ্বাস নেয়, তবে বুঝবেন তার গলায় হয়তো তার নিজের জিহ্বা, শ্লেষ্মা বা অন্য কিছু আটকে আছে যাতে বাতাসটা ঠিক মতো প্রবেশ করছে না।

 রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হার্টের অসুখের লক্ষণ।

শ্বাস টানবার সময় রোগীর দুটি পাঁজরের মাঝের চামড়া বা ঘাড়ের কোণের ( কন্ঠের হাড়ের পেছনের ) চামড়া ভেতর দিকে ঢুকে যাচ্ছে কিনা তা দেখুন। এর মানে ঢোকার পথে বাধা রয়েছে। এটা নানা কারণে হতে পারে- গলায় কিছু আটকে গেলে, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, বা ব্রঙ্কাইটিস হলে। যদি রোগী বলে যে, তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে, তাকে কয়েকটি প্রশ্ন করবেন :

 বুকে কোনো ব্যথা আছে ? শ্বাস নিলে বা কাশি হলে যদি বুকে ব্যথা বাড়ে, আর পাশ ফিরে শুলে কমে যায়, তবে সেটা নিউমোনিয়ার শুরুর অবস্থার লক্ষণ।

যদি হাঁটা, দৌড়ানো বা সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় বুকে ব্যথা বাড়ে, আর কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিলে চলে যায় তবে সেটা হার্টের অসুখের লক্ষণ।

রোগীর যদি কাশি থাকে তবে তাকে জিজ্ঞাসা করবেন যে তাতে তার ঘুমের অসুবিধে হচ্ছে কি না। কাশির সঙ্গে শ্লেষ্মা উঠছে কি না - উঠলে তা কতটা উঠছে, তার কী রং এবং তার সঙ্গে রক্ত আছে কি না - এসব জেনে নিবেন।

সকালের দিকে শুকনো কাশি সাধারণত বেশি ধূমপান করলে হয়। কাশির সঙ্গে অনেকটা করে সাদা রঙের শ্লেষ্মা উঠলে তা ব্রঙ্কিয়েকটেসিস বা পুরোনো ব্রঙ্কাইটিসের লক্ষণ।

কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, বিকেলের দিকে জ্বর আসা এবং ওজন কমে যাওয়া এ ধরনের লক্ষণ হলে যক্ষ্মা বলে ধরে নেবেন। রোগীর বয়স যদি ৪০-এর ওপরে হয় এবং সে যদি বেশি ধূমপান করে তবে এটা ফুসফুসের ক্যান্সারও হতে পারে।

চামড়া (Skin) পরীক্ষা করুন

অসুখ যতই অল্প মনে হোক রোগীর শরীর পরীক্ষা করা জরুরি। পরীক্ষার সময় শিশু বা ছোটদের সমস্ত জামা কাপড় খুলে ফেলা উচিত। লক্ষ্য করুন এমন কিছু দেখতে পাচ্ছেন কি না যা ঠিক স্বাভাবিক নয়। যেমন : ঘা, ফুসকুড়ি, ক্ষত, চামড়ার ভেতরে কাঁটা ধরনের কিছু, অস্বাভাবিক ধরনের কিছু, অস্বাভাবিক কোন দাগ, প্রদাহ (লক্ষণ হলো লাল, গরম, ব্যথা করা আর ফোলা) ফুলে উঠা, অস্বাভাবিক দলা দলা জিনিস, ফুলে উঠা লিম্ফের গ্রস্থি (গলায়, বগলে বা কুঁচকিতে ছোট ছোট ফোলো), চুল অস্বাভাবিকভাবে পড়ে যাওয়া বা চুলের রং ও চকচকে ভাব নষ্ট হয়ে যাওয়া, ভুরুর চুল পড়ে যাওয়া।

সব সময় ছোটদের পশ্চাৎ দেশের মাঝখানে, যৌনাঙ্গের চারধারে, হাত ও পায়ের আঙুলের ফাঁকে, কানের পেছনে, চুলের ভেতরে (উকুন, দাদ, ফুসকুড়ি বা ঘা আছে কি না দেখার জন্য) পরীক্ষা করবেন।

সাধারণতঃ সুস্থ ব্যক্তির শরীরের চামড়া মসৃণ ও তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে। জ্বর হলে গা গরম হয়, চামড়া খস্ খস্ ও কর্কশ হয়। জন্ডিস রোগে গায়ের চামড়া হলুদ আভাযুক্ত হয়। রক্তশূন্যতা রোগে গায়ের চামড়া কিছুটা ফ্যাকাশে দেখায়। তবে মোটামুটিভাবে মুখের চামড়া খস্ খস্ ও ফ্যাকাশে হওয়া অসুস্থতারই লক্ষণ।

সাদাটে ভাব-বিশেষ করে ঠোঁটে আর চোখের পাতার নিচে, রক্তস্বল্পতার (এনিমিয়া লক্ষণ)

নীলচে রং বিশেষতঃ যদি ঠোঁট বা নখ নীলচে বা কালচে দেখায় তবে বুঝবেন রোগীর মারাত্মক শ্বাস-কষ্ট বা হার্টের অসুখ হয়ে থাকতে পারে।

চামড়া যদি পাঁশুটে সাদা রঙের হয়, আর ঠাণ্ডা ভিজে থাকে, তবে বুঝতে হবে রোগী হয়তো শকের অবস্থায় আছে।

চামড়ার ও চোখের হলুদ রং সিরোসিস, এমেবিক এবসেস বা গলব্লাডার (পিত্তকোষের) রোগ থেকে হয়। একেবারে ছোট বাচ্চাদেরও এ রকম হতে পারে।

চোখ (ঊুব) পরীক্ষা করুন

রোগীর চোখের সাদা অংশ লক্ষ্য করুন। রং টা স্বাভাবিক, না লাল, না হলদে? রোগীর দৃষ্টিশক্তি বদলাচ্ছে কি না দেখুন।

রোগীকে খুব ধীরে ধীরে ওপর দিকে, নিচের দিকে আর একপাশ থেকে অন্যপাশে তাকাতে বলুন। তাকানোর সময় চোখ যদি ঝাঁকি দিয়ে বা অসমান ভাবে নড়ে যায় তাহলে মস্তিষ্কের কোন ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে।

চোখের মণির (চোখের ঠিক মাঝখানে কালো গোল অংশ) আকার লক্ষ্য করুন। মণি দুটি যদি খুব বড় দেখায় - তা শকের লক্ষণ হতে পারে। মণি দু'টি খুব ছোট দেখালে তার মানে এটি হতে পারে যে, কোন বিষ বা কোন তীব্র ঔষধ শরীরে কোন ভাবে ঢুকেছে। দুটি চোখের দিকে তাকান আর লক্ষ্য করুন দুটির মধ্যে বিশেষতঃ দুটি মণির আকারে কোন তফাৎ আছে কি না ।

দুটি চোখের মণি যদি ছোট-বড় হয় তবে মারাত্মক কোন রোগের লক্ষণ বলে ধরে নিয়ে অতি শীঘ্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

যে চোখের মণি বড় সেই চোখে যদি এত প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয় যে, তার জন্যে বমি হয়, তবে তা সম্ভবতঃ গ্লুকোমার লক্ষণ। যে চোখের মণি ছোট দেখাবে সে চোখের যন্ত্রণাকে আইরাইটিস বলে। এটি একটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ হতে পারে।

অজ্ঞান রোগী বা যে রোগী অল্প সময় আগে মাথায় আঘাত পেয়েছে তার দুটি চোখের মণি ছোট-বড় হলে তা মগজের কোন ক্ষতি অথবা সন্ন্যাস রোগ বোঝাতে পারে।

অজ্ঞান বা মাথায় আঘাত পাওয়া লোকের দু'টি চোখের মণি ছোটবড় কি না তা নিশ্চয় তুলনা করে দেখবেন।

কান (Ear) পরীক্ষা করুন

রোগীর কানে কোনো যন্ত্রণা বা ঘা আছে কি না সবসময় লক্ষ্য করবেন। বিশেষতঃ রোগী যদি শিশু হয় আর তার যদি জ্বর বা সর্দি হয়ে থাকে, শিশু বেশি কাঁদলে আর কান ঘষলে বা টানলে প্রায় দেখা যায় তার কানে ঘা হয়েছে।

যদি কানের লতির পেছনের চামড়া লাল দেখায়, সেই জায়গাটা চেপে দেখুন। চাপ দিলে যদি খুব বেশি যন্ত্রণা হয় তবে হয়তো হাড়ে জীবাণুর আক্রমণ হয়েছে, সেসব রোগী সাধারণত বেশি জ্বর হয় আর তাকে খুব অসুস্থ দেখায়।

কানের ভেতরটা দেখার জন্য আঙ্গুল দিয়ে আস্তে কানটা টানুন। তাতে যদি ব্যথা বাড়ে তবে বুঝবেন কানের লতির ভেতরে ঘা হয়েছে।

কানের ভিতরটা লালচে দেখাচ্ছে বা সেখানে পুঁজ আছে কিনা দেখুন। একটা টর্চ ব্যবহার করলে সুবিধা হবে। কখনো কোনো কাঠি বা অন্য কোনো শক্ত জিনিস কানের ভেতরে ঢোকাবেন না।

লক্ষ্য করুন রোগী কানে ঠিকমতো শুনছে কিনা বা এক কানে অন্যটার থেকে কম শুনছে কিনা।

মুখ, জিহ্বা ও গলা ( Oral Cavity & Throat ) পরীক্ষা করুন।

রোগীকে খুব অসুস্থ না দেখালেও ভাল করে তার মুখ, জিহ্বা আর গলা পরীক্ষা করুন। ঠোঁটের কোণে ফাটা বা ঘা থাকলে তা ভিটামিনের অভাব থেকে হতে পারে।

জিহ্বা দেখে সব সময় রোগ নির্ণয় করা যায় না, তবে কতগুলো বিশেষ রোগ জিহ্বা পরীক্ষা করে বুঝা যায়।

সাদাটে আর মসৃণ-এনিমিয়া।

নীল-শ্বাসের বা হাটের অসুখ।

শুকনো-শরীরে পানির অভাব।

ছোট-ছোট সাদা দাগ-ছত্রাকের আক্রমণে হতে পারে।

অতিরিক্ত স্নায়ুবিক দুর্বলতায় কিংবা জ্বরে জিহ্বা শুকনা হয়।

অতিরিক্ত লাল জিহ্বা পাকস্থলীর রোগ বুঝায়।

জিহ্বা সাদা লেপাবৃত হলে কোষ্ঠবদ্ধতা লিভারের কঠিন রোগ বুঝায়।

জিহ্বা লেপাবৃত তবে কিনারা লালচে হলে টাইফয়েড বা প্যারাটাইফয়েড বুঝায়

জিহ্বায় ছোট ছোট লাল দাগ থাকলে স্কারলেট জ্বর বুঝায়।

জিহ্বা একদিকে পড়ে থাকলে স্নায়ুবিক অথবা ব্রেনের দুর্বলতা বুঝায়।

জিহ্বা ঘা হলে ভিটামিনের অভাব বুঝায়।

জিহ্বার ভিতরে শুকনো, সামনের দিকে আর্দ্র হলে রোগ ভালোর দিকে বুঝায়।

জিভের বা মুখের ভেতরের পুরানো ঘা যদি সারতে না চায় তবে ক্যান্সার হতে পারে।

জিভের যেসব জায়গায় লোকে চুন বা তামাক দিয়ে পান খায়, সেখানে এ রোগ প্রায়ই দেখা যায়। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিন।

যাই হোক জিহ্বা হলো একটি মাত্র লক্ষণ। কাজেই জিহ্বা বাদেই অন্যান্য লক্ষণ দেখে বিচার সাপেক্ষে সকল সময় রোগ নিরূপণ করতে হবে।

গলার পেছনে দিকটা দেখতে হলে একটা চামচের উল্টে পিঠ দিয়ে জিহ্বাটা চেপে ধরে টর্চ জ্বেলে দেখুন।

গলার পেছনে জিভের দু'ধারের ডেলা দুটি হলো টনসিল। টনসিলে জীবাণুর আক্রমণ হলে তাকে টনসিলাইটিস বলে। এতে টনসিল দু'টি বড় হয়ে যায় আর রোগীর জ্বর হয়। এটি ছোটদের জ্বরের একটা প্রধান কারণ।

ছোট শিশুদের টনসিলের ওপরে আর গলার পেছনে সাদা বা ফ্যাকাশে পর্দা থাকলে ডিপথেরিয়া বোঝাতে পারে।

সূত্র: এক্মি স্বাস্থ্য কথা।

No comments: