Tuesday, July 26, 2016

যকৃতের প্রদাহ ( Hepatitis and Homeopathic Treatment)

সংজ্ঞা ( Definition ):  কোন কারণে যকৃতের তরুণ প্রদাহ এবং সেজন্য ক্রিয়াগত কোন বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তাকে যকৃৎ প্রদাহ বলে । Dr . P. C. Das বলেন – “ It is a disease characterized by anorexia, fever, jaundice and hapatomegaly caused by virus ” এই রোগে আক্রান্ত হলে যকৃৎ তার নিজস্ব ক্রিয়া শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং নানাবিধ রোগ উপসর্গ দেখা দেয় ।

কারণ ( Aetiology ):
  1. ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, কালাজ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্লেগ, সিফিলিস ইত্যাদি রোগের সংক্রমণ ।
  2. বিকোলাই, যকৃতের অ্যামোবায়োসিস প্রভৃতি রোগ ।
  3. পিত্ত নালীতে অবরুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি । পিত্ত পাথুরী, জীবাণু সংক্রমণ, পিত্তনালীর সংকোচন । পিত্তনালী, যকৃৎ, পাকস্থলী বা কিডনীতে অর্বুদ সৃষ্টি । ইহাকে অবরোধ জনিত যকৃৎ প্রদাহ Obstructive Hepatitis বলে ।
  4. সুরাপান, ক্লোরোফর্ম, কার্বনটেট্রাক্লোরাইড, আর্সেনিক, স্যাণ্টুনাইন প্রভৃতির বিষক্রিয়া এবং কতিপয় ঔষধের প্রতিক্রিয়াজনিত কারণ ।
  5. লিভারের সিরোসিস । এছাড়া ভাইরাস সংক্রান্ত যকৃৎ প্রদাহ সাধারণত তিনটি কারণে হতে পারে যথা – 1. Virua A . 2. Virus B . 3. Virus A এবং B বহির্ভূত ।
  • Virua A: এই জাতীয় ভাইরাস রোগীর মলে পাওয়া যায় । ইহারা প্রধানত খাদ্য ও পানীয় মাধ্যমে অন্ননালীর সাহায্যে শরীরে সংক্রমিত হয় ।
  • Virus B: এই জাতীয় ভাইরাস রোগীর রক্তে পাওয়া যায় এবং ইহারা Hepatitis Associated Antigen – HAA নামে অভিহিত ।
  • Virus A এবং B বহির্ভূত: এই জাতীয় ভাইরাস সাধারণত জলের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় । মাঝে মাঝে কোন বিশেষ অঞ্চলে এই জাতীয় ভাইরাস রোগ বিস্তার করে ।
লক্ষণানুসারে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন পদ্ধতি:
ঔষধ ও শক্তি > চেলিডোনিয়াম মেজাজ - Q : যকৃতের বিবৃদ্ধি । প্রস্রাব হলুদ । মুখে তিক্ত স্বাদ । গল ব্লাডার বা যকৃতে অবরোধজনিত জণ্ডিস । পিত্ত পাথুরী, চোখ মুখ গায়ের চামড়া হলুদ । মল ছাই অথবা গন্ধকের ন্যায় বর্ণ, জিহ্বায় তিক্ত স্বাদ । ডান স্ক্যাপুলার নীচে বেদনা, ক্ষুধাহীনতা, বমি ভাব । 

ঔষধ ও শক্তি > আর্সেনিক এল্বাম – 6 / 30 : শোক, দুঃখ, ভোঁ, মদ, তামাক পান হেতু । বিষক্রিয়া হেতু, অতিরিক্ত ঔষধ সেবন হেতু । উদরে জ্বালাময় বেদনা, গরমে উপশম । পিপাসা বেশী । বারে বারে অল্প জল পান । যকৃৎ ও প্লীহা বৃদ্ধি, উদরে শোথ । দুর্বলতা, অস্থিরতা, রাত্রে বৃদ্ধি ।


 ঔষধ ও শক্তি > লাইকোপোডিয়াম - 6 / 30 : ভয়, ক্রোধ, উৎকণ্ঠা, জ্বর, মদ্যপান হেতু । যকৃৎ অঞ্চলে অনবরত বেদনা, খিল ধরা । বেদনা ডানদিক হতে বামদিকে সম্প্রসারণ । যকৃৎ শক্ত ও কঠিন । আহারের পর পেট ফুলে উঠে । বায়ু সঞ্চয় । দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য ও মাঝে মাঝে উদরাময়, উদর শোথ, বার বার মুত্র ত্যাগ ।

ঔষধ ও শক্তি > ল্যাকেসিস - 6 / 30 : অত্যন্ত বাচালতা, প্রাতকালে বিমর্ষ । যে কোন খাদ্যে যন্ত্রণা হয় । ভীষণ ক্ষুধা, ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা । পাকস্থলীতে খামচানো ব্যথা । আহারে উপশম কিন্তু পরক্ষণেই বেদনা । ঢোক গিলতে গেলে লাগে কিন্তু কঠিনদ্রব্যে লাগে না ।

ঔষধ ও শক্তি > মার্কুরিয়াস ভাইঃ – 3 / 6 : সিফিলিস, গনোরিয়ার ইতিহাস । অ্যামিবা ষ্ট্রেপটো কক্কাই সংক্রমণ । যকৃৎ শক্ত, বৃদ্ধি ও বেদনা, স্থুল বেদনা । নড়াচড়া, রাত্রে বেশী, ডান পাশে শুতে পারে না । জণ্ডিস, স্রাবে দুর্গন্ধ ।

ঔষধ ও শক্তি > ল্যাপটাণড্রা – Q : যকৃতের কণকণে ব্যথা, পিত্তকোষ বেদনা । জিহ্বা হলুদ বর্ণের ময়লার প্রলেপ । কালচে দুর্গন্ধময় মল, জণ্ডিস । আলকাতরার মত কালো মল, নাভিদেসে বেদনা ।

ঔষধ ও শক্তি > চায়না - 6 / 30 : অবসাদকর স্রাব, জীবনীশক্তির ক্ষয় । প্লীহা ও যকৃৎ স্ফীত, বর্ধিত । জণ্ডিস, তলপেটে বায়ু জমে । পেটের ডান দিকে বেদনা, ফেনাময় অজীর্ণ মল ।


ঔষধ ও শক্তি > নেট্রাম সালফ - 6 / 30 : গনোরিয়া চাপা দেয়া, স্যাঁতসেঁতে বসবাস । ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া ভোগের পর যকৃৎ প্রদাহ, জণ্ডিস, পিত্ত বমি । পেটে ভয়ানক বেদনা, সুচ ফুটানো বেদনা । চাপ দিয়ে শুতে পারে না । প্রাতকালে উদরাময় ।


ঔষধ ও শক্তি > থেরিডিয়ন - 6 / 30 : T. B. যুক্ত ব্যক্তি, মাথা ঘোরে । মাথায় যন্ত্রণা, সামান্য নড়াচড়ায় বমি । বাম পার্শ্বের প্লীহা স্থানে হুল ফুটানো ব্যথা, মাথায় অসহ্য বেদনা, নড়াচড়ায় বৃদ্ধি ।


বায়োকেমিক ঔষধ
ঔষধ ও শক্তি > ফেরাম ফস – 3x / 6x : যকৃৎ পীড়ায় খুব উপকারী । প্রথমাবস্থায় যখন জ্বর, লিভার বেদনা এবং অস্থিরতার ভাব বর্তমান থাকে তখন প্রযোজ্য । রোগের প্রকোপকালে ২/১ ঘণ্টা অন্তর সেবন করলে উপশম বোধ হয় ।


ঔষধ ও শক্তি > ক্যালি মিউর – 6x: লিভারের কাজ বিঘ্নিত । জিহ্বা সাদা ময়লাযুক্ত, মলের রঙ সাদা । লিভার অঞ্চলে এবং ডানদিকে বেদনাবোধ । জণ্ডিস । পিত্তের দোষ এবং কোষ্ঠকাঠিন্য । শীত শীত ভাব সহ কামলা রোগের সৃষ্টি।


ঔষধ ও শক্তি > নেট্রাম সালফ - 6x: ক্রোধ হতে জণ্ডিস । মল সবুজাভ ও পিত্তযুক্ত । চোখ ও গায়ের চামড়া হলুদ । লিভার আড়ষ্টভাব, প্রচণ্ড বেদনা । গলব্লাডার অঞ্চলে এত বেদনা যে রোগী অস্থির হয়ে পড়ে ।


জণ্ডিস উপসর্গ ( Complication ):
যকৃৎ প্রদাহ যদি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় তবে নানাবিধ জটিল উপসর্গ দেখা দিতে পারে যেমন লিভার ফোঁড়া ( Liver Abcess ) হতে পারে । অনেক সময় লিভার ধীরে ধীরে ছিবড়ার মত হয়ে যায়, উহাকে বলে Cirrhosis of liver । অনেক সময় Liver Cancer হতে পারে ।

রোগ নির্ণয় ( Diagnosis ):
পিত্ত বমি, লিভার ব্যথা, বামস্কন্ধে ব্যথা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখে এই রোগ নির্ণয় করা যায় । এছাড়া X-Ray করলে লিভারের স্বাভাবিক ভাবটি ধরা পড়ে । Ultra sonography of liver, gall biadder, pancreas প্রয়োজন ।

পথ্য ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা ( Diet and Management ):
যেহেতু লিভার মানবদেহের পরিপাক, রক্ত শোধন, খাদ্য সঞ্চয় প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করতে বিশেষভাবে সহায়তা করে সেজন্য এই যন্ত্রটি যাতে সুস্থ থাকে এবং সবল থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ । লিভারের পক্ষে ক্ষতিকর অথবা লিভারের কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এমন কোন কাজ করা উচিৎ নয় । ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, বিকোলাই প্রভৃতি রোগ লিভারের যথেষ্ট ক্ষতি করে । অতএব ইহার যথার্থ চিকিৎসার প্রয়োজন । অতিরিক্ত বা অনিয়মিত পানাহার, গুরুপাক দ্রব্য আহার, উত্তেজক বা উগ্র দ্রব্য পান, অতিরিক্ত শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রম পরিহার করা উচিৎ । সাধারণ স্বাস্থ্য সম্মত নিয়মগুলো পালন করা উচিৎ । যথেচ্ছ ঔষধ গ্রহণের ফলে আজকাল লিভারের দোষ অতি ব্যাপক ভাবে দেখা দিয়েছে । সংক্রমণ, যকৃৎ প্রদাহের ক্ষেত্রে আমাদের খদ্য পানীয় সম্বন্ধে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে । ক্লোরিন হেপাটাইটিসের ভাইরাস ধ্বংস করতে পারে । এইজন্য ক্লোরিন মিশিয়ে পরিশোধন করে নেয়া উচিৎ । রক্ত প্রদানের ক্ষেত্রে রক্ত ভাইরাস যুক্ত কিনা সে বিষয়ে সুনিশ্চিত হতে হবে । সংক্রামক যকৃৎ প্রদাহের ক্ষেত্রে রোগীর পক্ষে পূর্ণ বিশ্রাম দরকার । যতদিন পর্যন্ত রোগী সুস্থ হয়ে না উঠে ততদিন পর্যন্ত বিশ্রামের প্রয়োজন । লঘু ও পুষ্টিকর খাদ্য দিতে হবে । খাদ্যে কোন চর্বি জাতীয় পদার্থ থাকবে না । রোগীর জন্য গ্লুকোজ পানীয় এবং প্রোটিনযুক্ত খাদ্যের ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন । খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেত্রে রোগীর ইচ্ছা এবং অনিচ্ছা বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন । রোগীর সেবাকারীদের স্বাস্থ্যসম্মত বিধিগুলো কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে । রোগীর মলমুত্র অপসারণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে । রোগী যদি দীর্ঘদিন জণ্ডিস রোগে আক্রান্ত হয় তৎসহ বমি ও বমিভাব, ক্ষুধাহীনতা জ্বর, লিভার বেদনা, চর্ম উদ্ভেদ ইত্যাদি থাকে তবে বুঝতে হবে অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে । আজকাল অত্যাধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে বটে কিন্তু সাধারণ লোকের পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা করানো সম্ভব নয় । অতএব খাদ্য, পানীয়, বিশ্রাম ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান হতে হবে যাতে রোগ না হয় ।

(From-Dr Shakhoat Hossen )